-মাহতাব ফারাহী
কিছুই বদলায়নি। বদলেছে কেবল ক্ষমতা। ঘুষের লেনদেন বদলায়নি। দখল, চাঁদাবাজি বদলায়নি। বদলেছে কেবল দখলদার, চাঁদাবাজ ও ঘুষ গ্রহীতা। চুরি, ছিনতাই বদলায়নি। খুন, রাহাজানি, হয়রানি, মিথ্যা মামলা বদলায়নি। সবকিছু আগের মতোই আছে। থাকবেও। মাঝ থেকে অভ্যুত্থানের নামে কতগুলো প্রাণ গেলো। সেদিন চায়ের দোকানে কয়েক জন ছাত্র নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিলো, শুধু শুধুই আন্দোলন করলাম। সুযোগে মধু খাচ্ছে কেন্দ্রীয় নেতারা। আমাদের কি লাভ হলো?
সত্যি! ছাত্রদের কি লাভ হয়েছে?এখনো অধিকারের জন্য লড়তে গিয়ে প্রাণ হারাচ্ছে তারা।
পাশাপাশি সাধারণ মানুষেরও কি কোন লাভ হয়েছে? আগে যেমন ছিলো, এখনো তেমনই আছে। দ্রব্যমূল্য কমেনি। বাস ভাড়া,বাড়ী ভাড়া কমেনি। বাচ্চাদের টিউশন ফি, পানি, বিদ্যুৎ এমনকি ময়লার বিলও কমেনি।
সত্যি বলতে কি, সাধারণ ছাত্র-জনতার জীবনে উল্যেখযোগ্য কোন পরিবর্তনই আনেনি ২৪ এর গণঅভ্যুত্থান। পরিবর্তন যদিও বা কিছু হয়েছে, তা কেবল আন্দোলনের সবচে' বেশি সুবিধা ভোগী প্রায় ১৭ বছর ধরে অভুক্ত দলীয় নেতা-কর্মীদের। মামলা হামলার কারণে আগে নিশ্চিন্তে বাড়ী-ঘরে ঘুমাতে পারতো না। এখন পারছে। পালিয়ে যাওয়া দলের নেতা-কর্মীদের অরক্ষিত জায়গা-জমি, প্রতিষ্ঠান দখল করতে পারছে। পত্রিকান্তরে অনেক নেতার ব্যাপারে এমন সংবাদই তো দেখছি। হু হু করে না-কি তাদের ইনকাম বাড়ছে। অন্যদিকে সাধারণ সাধারণ ছাত্র-জনতা? কেবল চেয়ে চেয়ে দেখছে। আগেও যেমন দেখতো।
প্রশাসনে দলীয়করণ করেছে ফ্যাসিস্টরা? হ্যাঁ, করেছে। সেই দলীয়করণ যদি অপরাধ হয়ে থাকে, এখন যে দলীয়করণ হচ্ছে, তাকে কি বলবেন? কৃষ্ণ করলে লীলাখেলা, অন্যরা করলে দোষ? এখন থানার যারা কর্তা বাবু, তারা কি সবাই নিরপেক্ষ? বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন? যারা পদোন্নতি পেয়ে ওসি, ডিসি, এসপি, সচিব, প্রশাসক, মেয়র হয়েছেন, হচ্ছেন, তারা স্রেফ যোগ্যতার মাপকাঠিতে বা নিয়মতান্ত্রিকভাবে নিয়োগ পেয়েছেন- এই কথা বলতে পারবেন গ্যারান্টি দিয়ে? আসলে কিছুই বদলায়নি। বদলেছে কেবল লীগ। তার বদলে দল এসেছে। জামাত এসেছে।
অমুক, তমুক পার্টি এসেছে। আসেনি কেবল সাধারণ মানুষের নাম। প্রতিষ্ঠিত হয়নি আমজনতার ক্ষমতা।
আগে ফেরারী দলটির নেতাকর্মীদের কথায়, অনুরোধে বদলি, নিয়োগ,বরাদ্ধ দেয়া হতো। এখন 'ব' 'জ' দলীয় নেতা-কর্মীদের অনুরোধের ঢেঁকি গিলতে বাধ্য হয় বর্তমান নতজানু ইন্টেরিম প্রশাসন।
'অনুরোধে' বললে ভুল হবে, বরং প্রশাসনকে রীতিমতো শাসিয়ে বেড়াচ্ছে আগামীর সম্ভাব্য সরকারী বা আধা সরকারী দলের নেতা-কর্মীরা।
অন্তর্জাল জুড়ে ঘুরে বেড়ানো এক অডিও ক্লিপে শোনা যায়, জনৈক জ' বর্গীয় নেতা থানার এক এসআইকে ধমক দিয়ে বলছেন, আপনি অমুকের বিরুদ্ধে মামলা নিলেন কেন? ধমক খেয়ে পুলিশ বেচারার 'ছেড়ে দে মা কেন্দে বাঁচি' অবস্থা। এই যদি হয় পরিস্থিতি, তাহলে ২৪ এর আগের আর পরের মধ্যে পার্থক্য রইলো কোথায়? আসলে কোনই পার্থক্য নেই, যাহাই বাহান্ন, তাহাই তিপ্পান্ন।
এবার একটু পেছনে ফেরা যাক।
এক এগারো'র পর মঈনুদ্দিন -ফখরুদ্দিন সরকারের আমলে বিএনপি-আওয়ামী লীগের যেসব নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল, পরবর্তীতে আওয়ামী সরকার এসে ঢালাওভাবে শেখ হাসিনা সহ কেবল তাদের দলীয় নেতা-কর্মীদের মামলা থেকে খালাস করে দিলো, আওয়ামী কারাবন্দীদের মুক্ত করে দিলো। ২৪ এর অভ্যুত্থানের পরেও মূলত তাই হয়েছে। কে অপরাধী, কে অপরাধী না -এগুলো বাছ-বিচার না করেই ঢালাওভাবে হাজার হাজার জেলবন্দীকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে কয়েকজন শীর্ষ সন্ত্রাসও রয়েছে। সুতরাং পরিবর্তনটা আর হলো কোথায়?
হ্যাঁ, এর মধ্যে কিছুটা বদল আনার চেষ্টা করছে জাতীয় সংস্কার কমিশন। বিভিন্ন বিষয়ে গঠিত পাঁচটি সংস্কার কমিশন ৬৯৪ টি প্রস্তাব এনেছে। কিন্তু এর মধ্যে অতীব গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবগুলোর সঙ্গেই সম্মত নয় এই মুহূর্তে দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি। মূলত বিএনপি যে সকল প্রস্তাব নাকচ করেছে সেগুলো বাস্তবায়ন না হওয়াই পরিবর্তনের জন্য সবচেয়ে বড় থ্রেট। শেকড়ের পরিবর্তন না হলে শাখা-প্রশাখার পরিবর্তন অসম্ভব। যেমন একই ব্যক্তি একাধারে প্রধানমন্ত্রী, দলীয় প্রধান ও সংসদ নেতা হতে পারবেন না; এক ব্যক্তি সর্বোচ্চ দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না—এই দুটি প্রস্তাবে একমত নয় দলটি। এক ব্যক্তি মাঝখানে বিরতি দিয়ে সর্বোচ্চ তিনবার প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন, এমন একটি প্রস্তাব আলোচনায় এলেও তা নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
মূলত যে কোন সরকারের স্বৈরাচারী মনোভাব তৈরি হয় ক্ষমতার অমরত্বের লোভে। যদি ২ বারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ না থাকে তাহলে কোন সরকার প্রধানই চাইবেন না তার নির্ধারিত শাসনামলে এমন কোন অন্যায় ঘটুক, যারা কারণে ক্ষমতার বাইরে গেলে তাকে বিচারের মুখোমুখি হতে হয়। কারণ এই প্রস্তাবে তাকে আল্টিমেটলি দুই মেয়াদের পরে ক্ষমতার বাইরে যেতেই হবে। ফলে তিনি তার দলের নেতা-কর্মীদেরকে জুলুম, জবরদখল, দূর্নীতি ইত্যাদি থেকে বিরত রাখবেন অথবা এই সব কাজে যুক্ত থাকলে অবশ্যই শাস্তির আওতায় আনবেন। ক্ষমতা চিরস্থায়ীভাবে ধরে রাখার জন্য নেতাকর্মী ও প্রশাসনের লোকদের অন্যায়কে আর প্রশ্রয় দেওয়ার প্রয়োজন হবেনা। এইভাবে দেশের সর্বস্তরে শান্তি-শৃঙ্খলার ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। কিন্তু অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন দূরে থাক, দেশের শাসনব্যবস্থায় পূর্বের অন্যায়-অনিয়মের ন্যুনতম পরিবর্তন আনাও সম্ভব নয়। কারণ বিএনপি সংস্কারে রাজী নয়। তাদের দরকার ক্ষমতা। এমন ক্ষমতা, যার কোন এক্সপায়ারি ডেট নেই।
সচেতন নাগরিকদের আশংকা, হয়তো শেষ পর্যন্ত বিএনপি ও তার সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর চাপে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংস্কার ছাড়াই নির্বাচন দিতে বাধ্য হবে এবং বিএনপি জোট যথারীতি ক্ষমতায় আসবে। তারপর কি হবে? এর উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে করিনা। ৫ আগস্টের পর দেশের সর্বত্র ক্ষমতার খুব কাছাকাছি বিশেষ দল বা দলসমূহের নেতাকর্মীদের কর্মকাণ্ডে এর উত্তর পাওয়া যাবে। তবে খোলাসা করে এতটুকু বলতেই পারি, পরিবর্তন কিছুই হবেনা। দেশটা অনিয়ম, অরাজকতার দখলেই থাকবে। এর অন্যথা হলে খুশির অন্ত থাকবেনা।
লেখক: সাংবাদিক, জনবক্তা
© Mahtab Farahi. All Rights Reserved. Designed by Mahtab Farahi